বাংলাদেশের ইতিহাসে সিরাজুল আলম খান অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে জুন মাসের ৯ তারিখ দুপুরে। তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলবে আরও বহু বছর। তাঁকে মহিমান্বিত করেই বেশির ভাগ কথাবার্তা হবে।
১৯৪৭ সালের পূর্ব পাকিস্তান মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে কী করে বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছিল, তার ঘটনাপ্রবাহ ও প্রস্তুতি নিয়ে যখন চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, তখন সেই বিশ্লেষকরা দেখতে পাবেন-১৯৬২ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ে এদশে যত রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এর সবকটিতেই নানাভাবে জড়িত ছিলেন ছোটখাটো সুঠামদেহী এক ব্যক্তি, যার নাম সিরাজুল আলম খান।
কখনো মিছিলের পুরোভাগে স্লোগান দিচ্ছেন, কখনো মাঝরাতে ঢাকা শহরের দেওয়ালে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে উত্তেজক চিকা মারছেন, কখনো পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি, লড়াই করছেন। আহত হচ্ছেন। আবার ফিরে আসছেন।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন। তখন আইয়ুবের সেনা শাসনের যুগ। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের যুগ। শেখ মুজিবের উত্থানপর্ব। সেই থেকে শুরু। শেষ হলো ৯ জুন ২০২৩ সাল।
সিরাজুল আলম খানকে নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা ধরনের মিথ ও মিথ্যা প্রচলিত আছে। সেগুলো খণ্ডণ করা দরকার বলে মনে করি।
১. একটা মহল তাকে রাজনীতির রহস্যপুরুষ বলে অভিহিত করে থাকে। এটা একটা ভুল অভিধা। তিনি কখনোই কোনো রহস্যপুরুষ ছিলেন না। আর সব রাজনীতিকের মতোই তার যাতায়াত ছিল সর্বত্র। অনুসারীদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। একেক সময় কথা বলতে বলতে রাত ফুরিয়ে আকাশে ভোরের সূর্য উঁকি দিত। তিনি প্রচার চাইতেন না। শুধু প্রচারবিমুখই যে ছিলেন তা নয়, ব্যক্তিগত প্রচারকে অপছন্দ করতেন। কেউ সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে আর সব নেতার মতো ক্যামেরার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন না। মিডিয়ার একটা অংশই তাকে রাজনীতির রহস্যপুরুষ বানিয়েছে। এর কারণ, আর সবার মতো চাইলেই তার ইন্টারভিউ পাওয়া যেত না। কাজেই তাকে ক্যামেরার সং সাজাতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকা দেওয়ার জন্য তাকে এ নাম তারা দেয়। দেখবেন কোনো রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী বা দায়িত্বশীল কেউ কখনো সিরাজুল আলম খানকে রাজনীতির রহস্যপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেননি। তার পরিচিতিরাও না। অনুসারীরা তো না-ই। স্রেফ মিডিয়ার কয়েকজন লোক একেবারেই অকারণে এ কাজটি করেছেন। খুঁজলে দেখা যাবে এদের মুরুব্বিদের প্রায় সবাই হচ্ছেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সেই সব পচে যাওয়া চীনপন্থি, যারা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশকে আবারও পূর্ব পাকিস্তান বানাতে তৎপর ছিলেন।
২. কেউ কেউ তাকে নৈরাজ্যবাদী রাজনীতিক বলে উল্লেখ করে থাকেন। এরা সবাই আওয়ামী ঘরানার লোক। পাতি রাজনীতিবিদ। নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা বা জ্ঞান না থাকলেও ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটি যেহেতু বলতে আরাম ও শুনতে মজাদার, তাই তারা সিরাজুল আলম খানকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসে এটা বলে থাকেন। সিরাজুল আলম খান নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী গণতন্ত্রী, যার মার্কসবাদে ছিল অবিচল আস্থা। তিনি রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। ছিলেন একজন স্বাপ্নিক তাত্ত্বিক ও অসাধারণ মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক সংগঠক এবং মোহ সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ম্যাজিশিয়ান।
৩. হ্যাঁ, ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে দু-তিন বছর তিনি তৎকালীন শেরাটন (বর্তমানে ইন্টারকন্টিনেন্টাল) হোটেলের লবিতে বসে বিকাল ও সন্ধ্যার দিকে দু-চারজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন এবং সময় কাটাতেন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন নিয়মিত। একজনের নাম আমানুল্লাহ। অন্যজন শফিউল আলম। আমানুল্লাহ সাহেব ছিলেন পাকিস্তান আমলের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একজন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি করাচিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন এবং তার রুমেই বসতেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে আমানুল্লাহ সাহেবের উল্লেখ আছে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি করাচি থেকে ঢাকায় এসে থিতু হন এবং ব্যবসায়ে মনোযোগ দিয়ে তাতে সাফল্য অর্জন করেন। শেরাটনের আসরের দ্বিতীয়জন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অতিপ্রিয় জনাব শফিউল আলম। ইনি ছিলেন অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক, যার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জনাব এএইচএম কামারুজ্জামান। আমানুল্লাহ ও শফিউল আলম ছিলেন হরিহর আত্মা। সেই পাকিস্তান আমল থেকে। জাসদের রাজনীতিতে তাদের খুব আগ্রহ ছিল। তারা সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে শেরাটনের আসরে আলোচনা করতেন। ওখানে আরও আসতেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান, জনপ্রিয় অভিনেতা আবুল খায়েরসহ আরও অনেকে। তারা যেটা করতেন, সেটাও বেশ মজার। এক টি-পট চায়ের অর্ডার দিয়ে সঙ্গে চার-পাঁচটা খালি কাপ আনতে বলতেন। টি-পট থেকে সব কাপে আধা আধা করে চা ঢালতেন, বাকিটুকু গরম পানি দিয়ে ভর্তি করে পুরো কাপ করে পান করতেন। একবার শেষ হলে দ্বিতীয়বার ঢালতেন এবং গরম পানি মিশিয়ে তা পান করতেন। কাপের আধাআধি হলে আবার গরম পানি ঢেলে কাপ ভরাতেন। এটা যে কোনো চালাকি বা কঞ্জুসি ছিল তা নয়। ওনাদের স্বভাব। আমনুল্লাহ সাহেবের দিলকুশার অফিসেও তারা ওভাবেই পানি মিশিয়ে চা পান করতেন। শেরাটনের আড্ডায় এক সন্ধ্যায় চায়ের বিল আসত ২৫০ টাকা। ওটা আমানুল্লাহ সাহেব দিতেন। মাঝেমধ্যে অনিয়মিত অতিথিদের কেক পেস্ট্রিও খাওয়াতেন। তার ব্যয়ভারও বহন করতেন আমানুল্লাহ সাহেব। সিরাজুল আলম খান পাঁচতারকা হোটেলে বেহিসাবি খরচ করে ভোগবিলাসের জীবনযাপন করতেন বলে যারা সাধারণ্যে নিজেদের ক্ষতস্থান চুলকাতেন, এ সত্যটা হয়তো তাদের রাতের ঘুম আর কখনো হারাম করবে না।
৪. সিরাজুল আলম খান ভারত বা সিআইএ-এর পক্ষ হয়ে কাজ করেননি। বিদেশের হয়ে যারা কাজ করে, তারা কোনো না কোনোভাবে বৈষয়িক বা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই তা করে। সিরাজুল আলম খান তার সারা জীবনে কখনোই কোনো ধরনের আর্থিক বা বৈষয়িক লাভ-লোকসানের পথে হাঁটেননি। তিনি চিরকুমার ছিলেন। তার কোনো ঘরসংসার বা ব্যক্তিগত সম্পদ ছিল না। বাড়ি, গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালান্স, শৌখিন কাপড়-চোপড়-কোনো কিছুই তার ছিল না। থাকতেন ভাইঝির সঙ্গে ভাড়া করা একটা বাসায়। ছোট ভাই পেয়ারা এবং আরও দু-একজন অনুগত শিষ্যের অর্থানুকূল্যে একেবারেই একটি নিুমধ্যবিত্তের জীবনযাপন করে গেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই মুখ্য চিত্রকর। তিনি যা কিছু করেছেন, তা এ দেশের মানুষের কল্যাণ ও সুখী জীবনের কথা ভেবেই করেছেন, অন্যকিছুর জন্য নয়।
৫. দুই ভিন্ন রাজনীতির কারণে তাদের চলার পথ ভিন্ন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একেবারে শেষ পর্যন্ত তার সম্পর্ক কেমন ছিল, তা তার নিজের বর্ণনাতেই পড়ুন: বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই আমি বলেছিলাম “মুজিব ভাই, আপানি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুনামের সর্বোচ্চ শিখরে। মহাত্মা গান্ধী, মাও সেতুং-এরা যেমন রাষ্ট্র পরিচালনায় না গিয়ে ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসাবেই রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন, আপনিও তাই করুন।” তিনি বলেছিলেন, জনগণ তাজউদ্দীনকে না, আমাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চায়। তারপর আরও বললেন, কী করছি না করছি, তা তো তোকে জানাবই।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত এমন কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না, যা মুজিব ভাই আমাকে না জানিয়ে নিয়েছেন। এই প্রথম তিনি আমাকে না জানিয়েই প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক সচিব হলো। এরপরে যখনই দেখা হতো, কথা বলার চাইতে চোখাচোখিই বেশি হতো, কোনো আলাপ-আলোচনা হতো না। সম্পর্কের রজ্জু এভাবেই ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে যায়।
৬. তার নাম ‘দাদাভাই’ না। এই দুনিয়ার কেউ তাকে দাদাভাই বলে ডাকত না। শুরুতে সবাই সিরাজ ভাই বলত। তার ছোট ভাই-বোনেরা তাকে দাদা ডাকত। এটা সবার জানারও কথা না। কাজী আরেফ আহমদ তার এই পারিবারিক সম্বোধনটিকে পার্টির ভেতরে চালু করেন। আস্তে আস্তে তিনি সিরাজ ভাই থেকে স্থায়ীভাবেই ‘দাদা’ নাম ধারণ করেন। কিছু কিছু অতি উৎসাহী লোক তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও স্নেহাধিক্য প্রমাণের জন্য তার প্রসঙ্গ এলে তাকে ‘দাদাভাই’ বলে উল্লেখ করেন। এসব লোকের অধিকাংশই সিরাজভাইকে কখনো দেখেননি বা তার সঙ্গে কথাবার্তাও বলেননি।
বস্তুত তিনি কখনোই ‘দাদাভাই’ বলে সম্বোধিত হতেন না। না তার পরিবারে, না তার বৃহত্তর পরিবার অর্থাৎ তার রাজনৈতিক অনুসারীদের মধ্যে।
শামসুদ্দিন পেয়ারা : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক