লেখক, শিক্ষক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির চারদলের জোট সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হন। তখন দৈনিক যুগান্তরের 'রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ' (শব্দগুলো সত্যেন সেনের উপন্যাস থেকে ধার করা) শিরোনামের নিজের সাপ্তাহিক কলামে সাংবাদিক, শ্রদ্ধেয় আবেদ খান দাবি করেন- তিনিও নাকি সরকারের 'গ্রেপ্তারের' তালিকায় ছিলেন, তবে 'ভাগ্যগুণে' রেহাই পান! ঢাকার সাংবাদিকতার পাড়ায় তখন রটে, ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন আবেদ খানকে আশ্বস্ত করে, তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার 'আশঙ্কা' বা, 'সম্ভাবনা' নেই। এমন কোনো কারণও বিদ্যমান নেই।
২০১০ সালের ২ জুন মহাজোটের সরকার দৈনিক আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে এর চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধে সরকারের ভেতর থেকে জুন মাসকেই বেছে নেন কে, বা কারা! ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পত্রিকার প্রকাশনা বিষয়ক এক সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের সরকারকে বিতর্কিত করে। আমার দেশ'র প্রকাশনার ও মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে ঢাকার বরেণ্য সম্পাদক, সাংবাদিকরা বিবৃতি দেন। আমার দেশের পক্ষে পত্রিকাটির তখন সাহিত্য ও ফিচার সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় হাসান হাফিজ যোগাযোগ করেন আবেদ খানের সঙ্গে, বিবৃতিতে তাঁর সাক্ষরের জন্যে।
আবেদ খান বিবৃতিতে সাক্ষর করেননি। কেন সাক্ষর করেননি, এ 'ব্যাখ্যা' দিয়ে তিনি একটা কলামও লেখেন এক পত্রিকায়। অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের অভিযোগ- দেশের সরকার ও ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন- দুটিকেই খুশি রাখতে আবেদ খান ওই কলাম লেখেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনিই সম্ভবত একমাত্র সাংবাদিক, যিনি মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন না পেলেও এক পত্রিকায় 'ওপেন সিক্রেট' শিরোনামের প্রতিবেদন লেখে নিজের কেনা দামি গাড়িতে চড়তেন। ওই পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ঘাতকও 'সাংবাদিকতা' করতেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওই পত্রিকা, এর মালিকের জড়িত থাকার বিষয়টি একটা সময় যুুক্তরাষ্ট্রের 'গোপন দলিলে' উঠে আসে।
সাংবাদিক, শ্রদ্ধেয় মাসুদ কামাল গত ২২ নভেম্বর এক স্ট্যাটাসে আবেদ খানের ভূমিদস্যুতা প্রসঙ্গে লেখেন, "ধানমন্ডির (ঢাকার) ৩০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ি লাভের স্বপ্ন ভেঙে গেলো 'প্রখ্যাত সাংবাদিক' আবেদ খান ও তাঁর সহযোগীদের। আদালত বলেছেন, এ বাড়ি সরকারের। সেই সঙ্গে তথ্য গোপন করে রিট করার অপরাধে আবেদ খানকে জরিমানাও করা হয়েছে।
এ খবর পড়ার পর থেকে দারুণ অস্বস্তিতে আছি। এতো বড় এক সাংবাদিক, যাঁর নামেই একটা পত্রিকা চলে (সবশেষ দৈনিক কালবেলা সে রকমই একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে), তিনি কী না এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত! আমাদের পেশায় জ্যেষ্ঠদের দিকে আর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাতে পারছি না কেন? যার দিকেই তাকাই, অশ্রদ্ধা আর অস্বস্তি যেন প্রতিযোগিতা দিয়ে বেড়ে যায়!"
মাসুদ কামালের স্ট্যাটাসে বাসসের প্রধান সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় আবুল কালাম আজাদ মন্তব্য করেন, 'ঘটনাটি ১৯৮৭ সালের। আমি তখন অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিতীয় মেয়াদের সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ফোরামের মনোনীত। আমাদের মনোনীত সভাপতি প্রার্থী শাহজাহান মিয়া পরাজিত হন মাত্র ১২ ভোটে। আবেদ খান জামায়াত-বিএনপির ফোরামের প্রার্থী হিসেবে সভাপতি হন। তিনি এর আগে অনেকবার পরাজিত হন। ... সামরিক শাসক এরশাদের সময় তখন, পূর্তপ্রতিমন্ত্রী তখন শফিকুল গনি স্বপন, তার সাহায্য নিয়ে বাড়িটি (ধানমন্ডির) নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা করেন আবেদ খান।'
সাংবাদিক, শ্রদ্ধেয়া মুন্নী সাহা ওই স্ট্যাটাসে লেখেন, ''আমাদের সিইও (এটিএন নিউজ) হিসেবে আবেদ ভাই ( আবেদ খান) কিছুদিন কাজ করেছেন। সে সময় পাকিস্থান দিবস উপলক্ষে ১৪ আগস্টে এক ডকুমেন্টরি প্রচারে প্রায় বাধ্য করছিলেন। জাতীয় শোক দিবস নিয়ে তখন আমাদের চ্যানেলে তিনদিনের বিশেষ রিপোর্ট, টকশো ... এসব চলছিলো। আবেদ ভাই, কোনো কিছু কনসিডার করতে চাইছিলেন না। পলিটিক্যালি কারেক্ট-ইনকারেক্ট নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করার অপরাধে চেয়ারম্যানকে (এটিএন নিউজের) নালিশ করেছিলেন। পাকিস্থান অ্যাম্বাসিতে ফোন করে, ডকুমেন্টারি চালানোর জন্য টাকা এনে দেবেন ... এমন কথাও বলছিলেন। প্রভাষ আমিনসহ আমরা দু'একজন শক্ত প্রতিবাদ করায় তাঁকে থামতে হয়েছিলো।''
আমাদের প্রজন্ম, যাদের নব্বইয়ের দশকে পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তাদের সঙ্গে আবেদ খানের পরিচিতির অন্যতম মাধ্যম ছিলো যুগান্তরে প্রকাশিত তাঁর কলাম 'রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ'। কলামের নামকরণ আমৃত্যু বামপন্থি, উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের উপন্যাস থেকে। এ নামকরণের মধ্য দিয়ে আবেদ খান পাঠকের কাছে নিজেকে 'বামাদর্শের' হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন? যে কোনো আদর্শই তো অবিরত সংগ্রামের। তেমন অবস্থানে কী আবেদ খান আছেন? আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণের' শুরুটা একেবারে সরল সাদামাটা এক সংক্ষিপ্ত বাক্যে, ‘বিভার চিঠি এসেছে।’
আমরা, সাংবাদিকতায় যারা নতুন, আনাড়ি- তারাও কী সরলপনায় এ পেশায় আবেদ খানকে 'আদর্শিক অনুকরণীয় ব্যক্তি' হিসেবে ভেবে নিয়েছি! অথচ তিনিও ভূমিদানব! ভোরের পাতার কথিত সম্পাদক এরতেজা হাসান জমি সংক্রান্ত প্রতারণার মামলায় কারাগারে গেলে একটা যুক্তি দাঁড় করানো যায়, রিজেন্ট হাসপাতালের শাহেদরা কারাগারেই 'সুন্দর', বন্যেরা বনের মতো। আবেদ খানের মতো সাংবাদিক আদালতে জবর-দখলের দায়ে দণ্ডিত হলে আমাদের আত্মঅহংকারের জায়গাটা আর থাকে না। অথচ দৈনিক জনকণ্ঠে আবেদ খানের লেখা 'গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান' পড়ে আমরা কতো সময় খরচ করেছি।