মতামত

‘বিঘ্নিত পরম্পরা, স্বকিয়তা বিবর্জিত বাংলাদেশ’


আকতার হোসেন রতন, মুক্তমনা লেখক।
প্রকাশিত: রাত ০৯:০৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২






‘বিঘ্নিত পরম্পরা, স্বকিয়তা বিবর্জিত বাংলাদেশ’

সত্তর দশকে ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সার অনেক মান ছিল। অর্থনীতিবিদগন এর ব্যাখ্যা সুন্দরভাবে দিতে জানেন কেন তখন অমন আর এখনই বা কেন এমন। সময়ের সাথে উন্নতি আর মূদ্রার মান পরিবর্তন তো হবেই। তাই বলে সেই পয়সার ব্যবহার একদম নাই হয়ে যাবে তা মানতে কেমন এক কষ্ট লাগে। সেই সময়কার মানুষ যারা এখনও বেঁচে আছেন তাঁদের আবেগী মন এসব খুঁজে বেড়ায়। কেননা এর সাথে ছিল সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের নানা সুখ-দু:খের স্মৃতি। সে সময় এক পয়সা হাতে দিয়ে শিশুকে বলত, “যাও বাতাসা কিনে খাও আর মন দিয়ে পড়াশুনা করবা, মার কথা শুনবা, মুরুব্বীদের সম্মান করবা” ইত্যাদি উপদেশের এক অলিখিত কিন্তু বাধ্যগত চুক্তি। এখানে নেই প্রতিবাদী যুক্তি কিংবা অগ্রজ জনের অভিজ্ঞতাকে তূরী মেরে উড়িয়ে অনুজের পেশীশক্তির অবস্থানকে অগ্রগণ্য করতে বাধ্য করা। বেশীরভাগক্ষেত্রেই অগ্রগণ্য ছিল সমাজ সভ্যতার বিবেচনা ।

 নমনীয় ও আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের মানুষকে যদি বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে বলা হয় তবে প্রথমেই প্রশ্ন এসে যাবে এদেশের মানুষ কেমন? এর উত্তর দেয়া কারো পক্ষে এখন আর সহজ নয়, খুব কঠীন হয়ে গেছে। এমনটি ছিলনা, খুব সহজেই এর উত্তর দেয়া যেত। অতীতে বিশ্বের স্বনামধন্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এদেশ ঘুরে যাবার সময় বলত, “এদেশের মানুষের অতিথিপরায়নতা ভুলবার নয়।” সেই সহজ উত্তরের সাথে যুক্ত ছিল এদেশের মানুষ ধর্মপরায়ন কি মুসলিম কি হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ খৃষ্টান। অর্থাৎ সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এক জাতি। এখন প্রশ্ন জাগে যে দেশের মানুষ অচেনা মেহমানকে এত সেবা দিতে জানে সে দেশের মানুষ তাদের পিতা-মাতা-চাচা-চাচী-মামা-মামী-খালা-খালু-ফুফু-ফুফা-নানা-নানী-দাদা-দাদীর প্রতি এমনকি দুর সম্পর্কের আত্মীয় বা অনাত্নীয় মেহমানকে ও মুরুব্বীকে নিশ্চয় অনেক বেশী উচ্চাসন দেয়।  এমনি পরম্পরায় বংশের পর বংশ হয়েছে বিস্তার, প্রবীণজনের নৈতিক আদর্শ আর শিক্ষার ধারক বাহক হয়েছে নতুন প্রজন্ম। জেনেছে সভ্যতার বিধিনিষেধ, আর অনুসরন করেছে প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপের সূচি। শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র। এগিয়েছে অনেক। আর কীর্তিমানকে দরাজ গলায় চিহ্নিত করেছি “বাংলা মা কিংবা গর্বিত পিতার সন্তান”।

এ জাতির শুরু থেকে স্বাধীনতার বেশ পরেও এমনকি এখনও এই ২০২২ সালে বাংলা মা কিংবা বাবার সরলতা রয়ে গেছে অনেকাংশে। এমন সরল মানুষগুলো থেকে বের হয়েছে কত কীর্তিমান কিংবা মহিয়সী নারী। বাংলা মা দেখতে কেমন? গর্বিত পিতার অভিব্যক্তি কেমন? এর শুরু ও শেষ  অবস্থান কেমন? বাবা-মা কি সেকেলে? তাঁদের কথায় বা অভিব্যক্তিতে কি সন্তানের মান সন্মান চলে যায়? এমন নানা প্রশ্ন থেকে অনেক কীর্তিমান নিজের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে হয়েছে দেশান্তর কিংবা গৃহান্তর। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের পূর্বসুরীর এক বড় সংখ্যক তথাকথিত পুরাতন আদি সেকেলে মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। এখন যারা দেশের সিনিয়র সিটিজেন তারা রাষ্ট্রের সমবয়সী। তাদের পরবর্তী বংশধররাও এখন পিতা-মাতার আসনে।

এখনকার পিতামাতা আর সরল নয়। তবে সন্তানের প্রতি কি এক আজব মায়ায় সকল আবদার মিটিয়ে দেয়ার তৎপরতায় মত্ত হয়ে কখন সন্তান হয়ে উঠেছে নিজ স্বার্থে উম্মত্ত তা টের পাওয়ার আগেই জীবন চলে গেছে হতাশায় নিমজ্জিত। এখনকার সন্তানের মাথায় এখন আর আসবে না বাবা-মা’র সরলতার রূপ। কেননা বর্তমানের সিনিয়র সিটিজেনরা তাদের পূর্বসুরীদের মতাদর্শকে লালন করেনি। বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে পরম্পরা। কিংবা নিজ নিজ নেতিবাচক দিকগুলো ঢেকে রাখতে নতুন প্রজন্মকে ভুলিয়ে রেখেছে অন্য কোন মোহে। তবুও দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে সেই সব গুটিকয়েক বোধসম্পন্ন  নাগরিকের অবদানে।

দেশ এখন আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, নয় বঙ্গবন্ধু শহীদ জিয়া কিংবা পল্লীবন্ধু এরশাদের শাসনামলের বাংলাদেশ। সে সময়কার সুখ এ সময়ে আর মিলবে না। এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন তাই সুখ ও সখ ভিন্ন। রসিকতা করে এখনও মুরুব্বীরা বলে, “সেইদিন আর নাইরে নাতী, মুঠে মুঠে চিনি খাতি”। তখন ঘরভর্তি সন্তান পয়দা করে অশিক্ষিত বা কমশিক্ষিত মা-বাবা তীব্র মানসিক শক্তিতে সন্তানকে মানুষ করে বিশ্বের বড় বড় উচ্চাসন দখল করার মত প্রেরণা দিতে পেরেছে। প্রতিদানে অনেক সন্তান ছুটিতে দেশে ফিরে মা-বাবার কাছে সেই সরল সন্তান হয়েই থেকেছে সামান্য আবার অনেক সন্তানের কারনে চরম কষ্টে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।

সেই দেশে সেই দিন আর নাই। এখন টাকা কথা বলে, অজানা সেই তীব্র মানসিক শক্তিতে নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী উন্নয়নের বিভিন্ন রূপের মোহে আর নানা প্রলোভনে আকৃষ্ট বাংলাদেশ ভুলে গেল সাধারন জীবন। বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে বাবার-মার সাথে ঘর গেরস্থলী বা কৃষিকাজে সহযোগিতার উদাহরন, রত্নগর্ভা মা কিংবা সফল পিতার উদাহরন এখন মিডিয়ায় প্রচারের বিষয়বস্তু । অথচ এমন অনেক ছিল সে সময় যা প্রচারের প্রয়োজন হত না। একে অপরের সাফল্য দেখে উৎসাহিত হয়ে নেমে পরত কীর্তিমান হওয়ার প্রতিযোগিতায়। ছিল পূর্বসুরীদের নিকট হতে নির্দ্বিধায় সহযোগিতা পাওয়ার খোলা জানালা। জীবনাচার আর মানসিকতা এমনই পাল্টে গেছে যে কঠীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও মনে পড়ে না সোনার বাংলার পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের কথা। এমনি ভোলা মন যে ভুলে গেল শেরেবাংলা, সূর্যসেন, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, জিয়া কিংবা বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের কথা। ভুলে গেল একসময়ের নদীমাতৃকতার কথা। ভুলে গেল মুরুব্বীদের প্রাপ্যস্থান নিশ্চিত করা। ভুলে গেল হিন্দু-মুসলিমের-বৌদ্ধ-খুষ্টানের চরম বন্ধুত্বের কথা।

এখন আর কেউ খোঁজ রাখেনা কে কার সন্তান। ভুলে গেল বৃক্ষরাজিতে ভোরের পাখির ডাকে ঘুমভাঙ্গা সকাল। উম্মাদের মত ছুটে চলল একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে। হয়ে গেল এক স্বার্থপর ঐতিহ্যবিবর্জিত ২০২২ সালের বাংলাদেশ যেখানে নিজের গড়া সন্তানের অবহেলায় বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি, বৃদ্ধাশ্রম কিংবা আত্মহত্যা, হয়েছেন অপ্রকৃতিস্থ। অপরদিকে ধৈর্য পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে প্রবীনজন মহাপাপ জেনেও মুখে দোয়া কালাম পাঠ করে সেই আত্মহত্যার সরাসরি সম্প্রচার করে আগামীর জন্য কি উদাহরন ও শিক্ষা রেখে গেলেন? তাহলে কি এখনকার সিনিয়র সিটিজেনদের কারও কারও গোড়ায় গলদ রয়েছে? এমন কি শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন যে সামান্য ধৈর্যটুকু ধারন করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি?

প্রকৃতপক্ষে বলা যায় গত কয়েক দশকে চরমভাবে বিঘ্নিত হয়েছে ঐতিহ্য আর পরম্পরা, হারিয়েছে স্বকীয়তা। ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রীয় শ্লোগান “পরিকল্পিত পরিবার, সবার জন্য খাদ্য” কিংবা “সবার জন্য শিক্ষা”। সত্তর দশকের মহামূল্যবান একটাকা থেকে বর্তমানের মানহীন এক/দুই টাকার কয়েনের শ্লোগানও ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় অনেক উন্নতি ও সফলতার পরও ব্যক্তি পর্যায়ের বর্তমানে বেরিয়ে আসা অবক্ষয়ের কালো থাবা থেকে আমাদের মুক্ত করতে? নাগরিক ও পারিবারিক জীবন হোক সভ্য ও উন্নত। সমাজবিজ্ঞানীরা রাখুক অবদান। শুধু অর্থেনৈতিক উন্নতির পিছনেই না হোক একমাত্র লক্ষ্য, হোক সুন্দর সামাজিক সোনার বাংলার বৈশ্বিক দৃঢ় অবস্থান। 

আকতার হোসেন রতন, মুক্তমনা লেখক