
১৯৮০ সাল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে নতুন দিগন্ত আসে শাটল ট্রেন সার্ভিসের মাধ্যমে। শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের চবি ক্যাম্পাসে পৌঁছতে শাটলে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। শাটল ট্রেনকে শুধু ট্রেন বললে ভুল হবে, একে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণও বলা যায়।
যেখানে একই সঙ্গে প্রেম, গল্প, গান, আড্ডা, পড়াশোনা চলে। শাটলকে ঘিরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কত যে সুখ-দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই শাটল ট্রেনে এবার লেগেছে রঙের ছোঁয়া। রাঙিয়েছেন সুদূর জার্মানি থেকে আসা শিল্পী লুকাস জিলেঞ্জার ও লিভিয়া। কাজটি করেছেন নিজস্ব অর্থায়নে। যেখানে স্থান পাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, সংসদ ভবন, সিআরবি, সমুদ্র, সূর্যাস্তসহ নানা দৃশ্য।
লুকাসের জন্ম জার্মানির বার্লিনে। মা-বাবা দুজনই চিকিৎসক। ঢাকার একটি এতিমখানার ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করতে তাঁর বাংলাদেশে আসা। এরপর সেই এতিমখানার স্বত্বাধিকারী বাবুল আহমেদের সঙ্গে ২০২১ সালের শুরুর দিকে প্রথম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। সেখান থেকেই পরিচয় চবির নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক অরূপ বড়ুয়ার সঙ্গে। অরূপ বলেন, ‘লুকাস আমাকে আগেই বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশে ভিন্ন রকম কিছু করতে চান। পরে যখন আমাদের শাটল ট্রেন সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন শাটল ট্রেনে রাঙানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। ’
শুধু আগ্রহ প্রকাশই নয়, লুকাস এই কাজের জন্য বাংলাদেশে আসেন কয়েকবার। নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি। এরই মধ্যে পেরিয়ে যায় তিন মাস। অবশেষে ২১ জুলাই থেকে কাজ শুরু করেন। রোদ আর বৃষ্টির বৈরী আবহাওয়ায়ও থেমে থাকেনি তাঁদের কাজ। প্রতিদিন গড়ে ১৩-১৪ ঘণ্টা কাজ করেছেন। এভাবে মোট পাঁচ দিনের প্রচেষ্টায় রাঙিয়ে তোলেন শাটল ট্রেন।
লুকাস জিলেঞ্জার বলেন, ‘শাটল ট্রেন প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থী বহন করে। সেই ট্রেনে কাজ করতে পেরে গর্ববোধ করছি। সুযোগ পেলে সামনে বাংলাদেশে আরো কাজ করতে চাই। ’
শুধু চবির শাটলই নয়, লুকাস বিশ্বের নানা প্রান্তে চিত্রকর্মের ছাপ রেখেছেন। তিনি জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকার অনেক ট্রেন, গাড়ি, জাহাজ, উড়োজাহাজেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর শিল্পকর্মের সাক্ষী হয়ে আছে ইউক্রেনের কিয়েভ শহরের অসংখ্য ট্রেন।
চবির ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের মো. রিপন সরকার বলেন, ‘নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ধন্য এই ক্যাম্পাসের ঘুম ভাঙে শাটলের হুইসেলে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মতো আমার কাছেও শাটল মানে এক ভালোবাসার নাম। লুকাস জিলেঞ্জারের প্রচেষ্টায় আমাদের শাটল ট্রেন আজ পরিণত হয়েছে চলমান চিত্রশালায়। দেখে দারুণ লাগছে। ’
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাফা শারমিলার অনুভূতিটা এমন, ‘প্রতিদিন হাসি, গল্প, আড্ডা, গান-বাজনা নিয়ে শাটল ট্রেনে ছুটতে ছুটতে হাজির হই প্রিয় ক্যাম্পাসে। শাটল ট্রেনেই আমাদের বন্ধুত্ব, প্রেম, ভালোবাসার গল্প তৈরি হয়। এই শাটল এখন দেখতেও অসাধারণ। ’